শ্রমিক বাঁচলে দেশ বাঁচবে: মে দিবসের আহ্বান হোক বাস্তব পরিবর্তনের
📆 বিশেষ প্রতিবেদন | ১ মে ২০২৫ | আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
✍️ মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এ দিনটি শুধু ক্যালেন্ডারের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নয়—এটি ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটি সেই সংগ্রামের দিন, যে সংগ্রামে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাবি তুলেছিল—“৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা ব্যক্তিগত সময়।” শিকাগোর হে মার্কেটের সেই রক্তঝরা আন্দোলন আজও প্রতিটি শ্রমিকের হৃদয়ে গর্ব ও প্রেরণার প্রতীক হয়ে আছে।
শ্রমিক ছাড়া রাষ্ট্রের অগ্রগতি অসম্ভব
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা শিল্পায়ন—সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি হলো শ্রমিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে শ্রমিককে এখনও পর্যাপ্ত মর্যাদা দেওয়া হয় না। বিভিন্ন খাতের হাজার হাজার শ্রমিক আজও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, কর্মস্থলে তারা নিরাপত্তাহীন, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধাও নেই বললেই চলে।
বিশেষ করে গার্মেন্টস, নির্মাণ, কৃষি ও পরিবহন খাতের শ্রমিকদের দুর্দশা আরও বেশি। তাদের অধিকাংশই দিনশেষে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। অথচ তাদের ঘামেই টিকে আছে দেশ।
নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য ও হয়রানি এখনো বাস্তবতা
নারী শ্রমিকরা আজ কারখানা, মাঠ, বাজার—সবখানেই কাজ করছেন। কিন্তু সেখানেই তাদের সম্মান, নিরাপত্তা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক নারী শ্রমিক এখনও মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না, কাজের সময় লিঙ্গভিত্তিক হয়রানির শিকার হন, এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন। এটি শুধু একটি লজ্জার বিষয় নয়, বরং সামাজিক অবিচার।
শ্রমিকদের কল্যাণে আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এ শ্রমিকদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা উল্লেখ আছে—যেমন ন্যূনতম মজুরি, ছুটি, গ্র্যাচুইটি, বীমা, দুর্ঘটনা ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক শ্রমিক এসব অধিকার সম্পর্কে জানেন না, আবার জানলেও তা দাবি করতে ভয় পান চাকরি হারানোর আশঙ্কায়। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিক ইউনিয়নের কাজ করতে গিয়ে নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হন।
মে দিবস কি কেবল র্যালি, বক্তৃতা ও ব্যানারে সীমাবদ্ধ থাকবে?
প্রতিবছর মে দিবসে সরকারি-বেসরকারি নানা আয়োজন হয়—র্যালি, সভা, মিছিল, ফুল দেয়া, কবিতা আবৃত্তি। কিন্তু বাস্তব উন্নয়ন না ঘটলে এসব কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এই দিনটির আসল তাৎপর্য হলো—শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া।
যতক্ষণ পর্যন্ত একজন শ্রমিক তার শ্রমের প্রকৃত মূল্য না পাবে, যতক্ষণ না সে নিজেকে মানুষ হিসেবে সম্মানিত অনুভব করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মে দিবসের চেতনা অপূর্ণই থেকে যাবে।
নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব: মর্যাদা দিতে শিখি
বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে, একজন রিকশাওয়ালার ঘামে শহর চলে, একজন নির্মাণশ্রমিকের হাতেই গড়ে ওঠে অট্টালিকা, একজন গার্মেন্টস কর্মীর পরিশ্রমেই আসে বৈদেশিক মুদ্রা। তাই তাদেরকে অবহেলার চোখে নয়, শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। ছোট পেশা বলে কিছু নেই—আছে ছোট দৃষ্টিভঙ্গি।
এই মে দিবসে আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি হোক—
🔸 প্রতিটি শ্রমিকের জন্য ন্যায্য ও সময়োপযোগী মজুরি ঘোষণা
🔸 শ্রমিকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা
🔸 ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
🔸 নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
🔸 অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ ও চুক্তিভিত্তিক শোষণ বন্ধ
উপসংহার: শ্রমিকের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন
শ্রমিক বাঁচলে দেশ বাঁচবে—এই সত্য আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করব, ততই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। মে দিবস হোক একটি নতুন শুরুর দিন, একটি প্রতিজ্ঞার দিন—যেখানে শ্রমিককে আমরা দেখব মানুষের চোখে, সন্মানের চোখে। তাহলেই এই দিবসের ইতিহাস ও চেতনা সত্যিকার অর্থে সফল হবে।